রচনা: রূপপুর পরমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র / ruppoor nuclear power plant. সমস্যা ও সম্ভাবনা
রচনা: রূপপুর পরমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র / ruppoor nuclear power plant. সমস্যা ও সম্ভাবনা
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রচনা
ভূমিকা:
বাংলাদেশের জন্য পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। আমাদের দেশে বিদ্যুতের প্রচুর ঘাটতি রয়েছে। দেশের এই বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটাতে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিকল্প নেই। উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে প্রচলিত বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে নতুন পথের সন্ধানে যেতেই হবে আমাদের। আর এ ক্ষেত্রে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কোনোই বিকল্প নেই। এশিয়ার বেশির ভাগ জনবহুল দেশ যেমন চীন, ভারত, কোরিয়াসহ আরও অনেক দেশ এর প্রয়োজনীয়তা আগেই টের পেয়েছে এবং পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করেছে ও করছে। আমরাও আর পিছিয়ে নেই। বিদ্যুৎ একটি দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। দেশের অর্থনীতির সঙ্গে বিদ্যুতের সম্পর্ক খুব ওতপ্রোত হলেও জনসংখ্যার মাত্র ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎ সেবা পান। তবেও তা নিরবচ্ছিন্ন নয়। গ্রামাঞ্চলে এর অবস্থা আরও প্রকট। এ অসহনীয় পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা হলে যেকোনো নাগরিকেরই খুশি হওয়ার কথা।
আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কার বিদ্যুৎ মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক কালজয়ী অধ্যায়ের সূচনা করেছে। আমাদের ব্যক্তিজীবনের কাজকর্ম, বিনােদন, আরাম-আয়েশ সব কিছুই সম্ভব হয়েছে একমাত্র বিদ্যুতের কারণে । বিদ্যুতের অভাবে আমাদের জীবন নিষ্প্রাণ, নিষ্ফল ও অর্থহীন হয়ে পড়ে । মােটকথা, আধুনিক জীবনের সবক্ষেত্রে বিদ্যুৎশক্তিই হলাে সাফল্যের চাবিকাঠি।
পরমাণবিক বিদ্যুৎ কী:
পরমাণু বিদ্যুৎ প্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় প্রক্রিয়াজাত ইউরেনিয়াম অথবা থােরিয়াম-এর নিউক্লিয়াস ভেঙে দুটি ক্ষুদ্রতম অংশে বিভক্ত হয়ে শক্তি সৃষ্টি করে এবং দুটি অথবা তিনটি নিউট্রন নির্গত করে। এ কিউশান পদ্ধতির মাধ্যমে চেইন রি-অ্যাকশন সৃষ্টি করা যায়। ফলে এই শক্তি এক ব্রিাট তাপের সৃষ্টি করে যাকে পরবর্তী সময়ে বিদ্যুতে পরিণত করা যায়। এ বিদ্যুৎকেই পরমাণু বিদ্যুৎ বলা হয়। এর শক্তি এত বেশি যে এক কিলােগ্রাম ইউরেনিয়ামে যে শক্তি তা দুই হাজার ৫০০ টন কয়লা পােড়ালে যে শক্তি হবে তার সমান। এ পদ্ধতি অত্যন্ত কঠিন, জটিল ও বিপজ্জনক। এর জন্য দরকার দক্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অবশ্য এর ব্যতিক্রম ঘটিয়েনিউক্লিয়ার বােমা তৈরি করা হয়েছিল। তার পরপরই ১৯৫০-এর দিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইসেন হাওয়ার ‘Atom For Peace’ অর্থাৎ শান্তির জন্য অ্যাটম কর্মসূচি হাতে নেন। ফলে গড়ে ওঠে ‘আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা। এর তত্ত্বাবধানেপরবর্তী সময়ে আণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার হয় পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালেই বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এর পর থেকে আণবিক শক্তি সংস্থাবহুভাবে বহুমাত্রিক সাহায্য করে যাচ্ছে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনকে। পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে আমেরিকা, ফ্রান্স, জাপান, কোরিয়া, চীন, তুরস্ক এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করেছে। পরমাণু বিদ্যুতের প্রয়ােজনীয়তা শুধু যে আজকের প্রতিপাদ্য, তা নয়— স্বাধীনতা পূর্ব বাংলাদেশে এর প্রয়ােজনীয়তার কথা আমাদের দেশের পরমাণু বিজ্ঞানীরা বলেছেন। এমনকি পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশন যখন ১৯৬১ সালে পারমাণবিক বিদ্যুতের বিষয় মাথায় আনে, তখন থেকেই বিষয়টি প্রাধান্য পায়। পাকিস্তানে পারমাণবিক বিদ্যুতের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য ইন্টারনিউক্লিয়ার কোম্পানি এবং গিরস অ্যান্ড হিল ইন করপরেটেড অব আমেরিকা কাজে লাগানাে হয়েছিল। তারা তাদের রিপাের্ট তদানীন্ত পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশনের কাছে জমা দেন। তাতে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানে পদ্মা নদীর তীরে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পাশে পাবনার রূপপুরে কারিগরি ও অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রকল্প গ্রহণ বাস্তবসম্মত। কিন্তু পাকিস্তান সরকার ঔপনিবেশিক মনােভাবের কারণে চেয়েছিল এটা করাচিতে স্থাপিত হােক। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম সুপারিশ করে ওয়াকিং সুপ। ১৯৮৪-৮৫ সালে ফ্রেন্স পাওয়ার রিঅ্যাক্টর এবং জাপানি টারবাে জেনারেটর স্থাপন প্রক্রিয়া শুরু করে। আশির দশকের প্রথমার্ধে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প জাতীয় চাহিদা হিসেবে দেখা যায়। এরপর আবার রাশিয়ার সাহায্যে প্রস্তাব বিবেচনায় আনা হয়। কিন্তু চেরননবিল পারমাণবিক দুর্ঘটনার পর সব ভেস্তে যায়। এ দেশে সােচ্চার হলাে পারমাণবিক বিদ্যুৎবিরােধী কিছু বুদ্ধিজীবী এবং বিজ্ঞানী।
বাংলাদেশ ও রাশিয়া পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষর:
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে কাঙ্ক্ষিত স্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকার পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন ও এর যথােপযুক্ত ব্যবহারে বিশেষ নজর দিচ্ছে। বর্তমানে দেশের মােট জনসংখ্যার মাত্র ৮০ শতাংশ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় রয়েছে। দেশে বর্তমানে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ৩২১ কিলােওয়াট ঘণ্টা । যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর অনেকগুলাে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বাণিজ্যিকভাবে চালু করেছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার রাশিয়ার সাথে ২০০৯ সালের ১৩ই মে একটি প্রাথমিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। যাতে বলা হয়, ১ হাজার মেগাওয়াটের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে। এতে আনুমানিক ব্যয় ধরা হয় ১৫০ কোটি মার্কিন ডলার। ২০০৯ সালের ২১-এ মে মস্কোয় বাংলাদেশ ও রাশিয়া পরমাণু জ্বালানির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সহযােগিতা কাঠামাে চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়।পরমাণু জ্বালানির সম্ভাবনা:
পরমাণু জ্বালানি সম্পর্কে বলা হয় এ জ্বালানির মাধ্যমে কার্বন নির্গমন হয় কম। যা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে না। ভারতে কয়লা পােড়ানাের ফলে সেখানে কার্বন নির্গমন এক বছরে ২৭৯ দশমিক ৬১ ও বাংলাদেশে ৮ দশমিক ৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন, পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পের স্বচেয়ে বড় সুবিধা হলাে কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন। আর এই বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে আলােকিত হবে বাংলাদেশ। এই বিদ্যুৎ পৌছে যাবে গ্রাম থেকে গ্রামে।নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য
সম্পাদনা
এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য নির্বাচিত পারমাণবিক চুল্লিতে নিম্নবর্ণিত পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য থাকবে:[৮]
ফুয়েল পেলেট:
পারমাণবিক চুল্লির পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রথমটি হচ্ছে ফুয়েল পেলেট, যা অতি উচ্চ তাপমাত্রায় তার জ্বালানী বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে পারে। ফুয়েল পেলেট সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরী করা হয়, ফলে তেজস্ক্রি ফিশন প্রোডাক্টসমূহ পেলেটের ভেতরে অবস্থান করে।
ফুয়েল পেলেটগুলো জিরকোনিয়াম অ্যালয়ের তৈরী ফুয়েল ক্ল্যাডিং দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে। বিশেষ কোন কারণে সামান্য পরিমাণ ফিশন প্রোডাক্ট ফুয়েল পেলেট থেকে বের হয়ে আসলেও তা এই ক্ল্যাডিং এ ভেদ করতে পারবে না।
রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল:
নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের জন্য বিশেষ মান নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পুরু ইস্পাতের প্রেশার ভেসেল তৈরী করা হয় যা, উচ্চ তেজষ্ক্রিয় অবস্থাতেও দীর্ঘস্থায়ী হয়।
প্রথম কন্টেইনমেন্ট ভবন:
রিইনফোর্সড কনক্রিট দিয়ে ১.২ মিটার পুরুত্বের প্রথম কন্টেইনমেন্ট ভবন তৈরী করা হয়, যা যেকোন পরিস্থিতিতে তেজস্ক্রিয়তা পরিবেশে ছড়িয়ে পড়া থেকে বিরত রাখে।
নিরাপত্তা ব্যবস্থা অধিকতর জোরদার করার জন্য আধুনিক নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টগুলোতে প্রথম কন্টেইনমেন্ট ভবন-এর পর আরও ০.৫ মিটার পুরুত্বের আরও একটি কন্টেইনমেন্ট ভবন যুক্ত করা হয় যা বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিমান দুর্ঘটনা ইত্যাদি থেকে প্লান্টকে সুরক্ষা করে।
এই পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যের কারণে মনুষ্য সৃষ্ট ঘটনা/দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন- শাক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়, ভুমিকম্প, বন্যা ইত্যাদিও প্রভাব মোকাবেলায় সক্ষম থাকবে এই পারমাণবিক চুল্লি।
Comments
Post a Comment