মানব উন্নয়ন সূচক কী?||What is the Human Development Index?||মানব উন্নয়ন সূচক মাপার উপায় || মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থা আলোচনা কর?

     মানব উন্নয়ন সূচক কী?||What is the Human Development Index?||মানব উন্নয়ন সূচক মাপার উপায় || মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থা আলোচনা কর?

   মানব উন্নয়ন সূচকঃ

মানব উন্নয়ন সূচক হলো বিশ্বের সকল দেশসূমহের জীবন মান,শিক্ষা,নিরক্ষতা প্রভৃতির একটি তুলনামুলক সূচক।এর সংক্ষেপ  HID(Human Development  Index.)

জিডিপি , জিএনপি এবং মাথাপিছু আয় ইত্যাদি হিসাবগুলােতে যে সমস্ত শ্রম বাজারে বিক্রি করা হয় না সেগুলােকে ধরা হয় না । ফলে একটি বিশাল জনগােষ্ঠীর শ্রম জাতীয় আয়ের অংশ হিসাবে মর্যাদা পায় না যা প্রকারান্তরে মানুষে মানুষে অসমতা সৃষ্টি করে । যেমন , গৃহস্থালি দৈনন্দিন কাজে নারীরা যে শ্রম দেয় তা হিসাবের মধ্যে না নেওয়ায় একদিকে যেমন মােট জাতীয় উৎপাদনের প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায় না , অন্যদিকে তা গৃহস্থালি কাজে নারীর শ্রমকে মূল্যহীন করে তােলে । 


উপরােক্ত সমস্যাসহ আরও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে একটি দেশের মানুষ প্রকৃত বিচারে কেমন আছে তা জানার জন্য ব্যবহার হচ্ছে মানব উন্নয়ন সূচক ' ( Human Development Index ) ধারণা । 

এখানে নানান সূচক ব্যবহার করে দেখা হয় যে , একটি দেশের অর্থনীতি কতটা কল্যাণমুখী । কয়েকটি উল্লেখযােগ্য সূচক হচ্ছে গড় আয়ু , গড় সামাজিক অসমতা , প্রসবকালীন মৃত্যুর হার , বেকারত্বের হার , দারিদ্র্যের হার , শিশ্রমের হার , কর্মহীন ও সামাজিকভাবে অসহায় হতদরিদ্রের হার , বাল্যবিবাহের হার , বাল্য মাতৃত্বের হার , আয়ের বৈষম্যের হার , সাক্ষরতার হার , পরিবেশ বান্ধব টেকসই উন্নয়ন ইত্যাদি

 কোনাে দেশের জনগণের জীবনযাত্রার মান কেমন তা বােঝার জন্য এ সংক্রান্ত কিছু নির্ধারক তথ্য প্রয়ােজন যাকে সেগুলাের মান উন্নয়নের সূচক বলা হয় । যেমন , জনগণের সাক্ষরতার হার কতো , সংখ্যা বা হরি কতো , তাদের আয় কতাে , ব্যয় কতো , । কেমন বাড়ি ও চিকিৎসা পাচ্ছে , তাদের খাদ্য গ্রহণের অবস্থা কেমন ইত্যাদি । এ ধরনের বেশ কিছু সূচককে একত্রিত করে বলা হয় । ঐ দেশ বা জনগােষ্ঠীর জীবন যাত্রার মান কেমন ।

মানব উন্নয়ন সূচক মাপার উপায়ঃ

শুধু উন্নয়ন কী সেটা নিয়ে বিতর্ক নেই, কিভাবে উন্নয়টা পরিমাপ করবো সেটা নিয়েও বড়ই ঘাপলা রয়েছে। সে যাই হোক, উন্নয়নটা হলো এমন কিছু যা পরিমাপ বা নিরূপন করার প্রয়োজন পড়ে। উদাহরণ হিসেবে দেখুন, নীতিতৈরীকারকরা কোন জনগোষ্ঠী বা সমাজের জন্যে নীতি তৈরী করতে গিয়ে সামাজিক উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর অবস্থান কি তা খতিয়ে দেখে। অন্যদিকে কোন প্রচার সংগঠন (campaign organizations) কোন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অবস্থা উন্নয়নের জন্যে প্রথমে অনুসন্ধান করে কিভাবে তারা প্রান্তিকতায় স্বীকার হয়।

উন্নয়ন পরিমাপের জন্যে একটি প্রক্সি পরিমাপক দরকার। যেমন, বিশ্বব্যাংক অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিমাপের জন্যে মোট জাতীয় আয় বা GNP ব্যবহার করে।এটাই বর্তমান সময়ে বহুল ব্যবহৃত অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিমাপক


অন্যদিকে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচী কর্তৃক ব্যবহৃত ‘মানব উন্নয়ন সূচক’ মানব উন্নয়ন বুঝার জন্যে তিনটি চলক ব্যবহার করে থাকেঃ স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অবস্থা। এসব চলক পরিমাপের জন্যে বিভিন্ন সূচক নির্ধারণ করতে হয়, যা করা এত সোজাসুজি ব্যাপার নয়।যেমন, মৌলিক চাহিদা বলতে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ও কর্মসংস্থানকে বুঝায়, কিন্তু এ উপাদানগুলোকে কিভাবে পরিমাপ করা হবে সেটা ততটা সোজা নয়।


উন্নয়ন পরিমাপ নিয়ে আরো একটি সমস্যা হলো বিভিন্ন সময় বা বিভিন্ন দেশের মধ্যেকার তুলনা নিয়ে।যেমন, জাতীয় শুমারীর মাধ্যমে বিশাল তথ্যভান্ডার সৃষ্টি করা যেতে পারে, কিন্তু সেটা বিশ্লেষণ করতে হলে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বা পেশাজীবি লোক ও প্রযুক্তির প্রয়োজন পড়ে, যা অনেক দেশের নেই।তাছাড়া সংগৃহীত তথ্য বিভিন্নভাবে বাদ পড়তে পারে, সেক্ষেত্রে পরিমাপটাতে কি প্রভাব পড়বে সহজে অনুমেয়।


 মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থাঃ

 বর্তমানে মােট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন , মােট জাতীয় উৎপাদন ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকার সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মানব সম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে আর্থ - সামাজিক খাতে বাজেটের ২০ % বেশি ব্যয় করছে ।

মানব উন্নয়ন সূচকে গত বছরের তুলনায় দুই ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। সূচকে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান ১৩৩।

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) ২০২০ সালের দ্য হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের পঞ্চম অবস্থানে আছে। তবে পরিবেশের প্রভাবজনিত সমন্বিত মানব উন্নয়ন সূচক অনুযায়ী আরও ৯ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ।

ইউএনডিপির বাংলাদেশে প্রকাশিত ‘মানব উন্নয়ন সমীক্ষা-২০২০’ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।

 ২০১৯ সালের Human Development Report মােতাবেক মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৫ তম যা ২০১৪ সালে ছিল ১৪২ তম । সরকার শিক্ষার সকল স্তরে সমান সুযােগ সৃষ্টি ও শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির মাধ্যমে দক্ষ ও যােগ্য মানব সম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়নসহ নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে । সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬০ % মহিলা শিক্ষক নিয়ােগের বিধি প্রবর্তনের ফলে মহিলা শিক্ষকের হার ১৯৯১ সালের ২১ % থেকে বর্তমানে ৬৪,৯ % উন্নীত হয়েছে । এছাড়া সরকার স্বাস্থ্য , পুষ্টি ও জনসংখ্যা খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় প্রজনন হার ও মৃত্যু হার কমেছে , গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে , নবজাত শিশু ও মাতৃ - মৃত্যু হার উল্লেখযােগ্য হারে কমেছে , অপুষ্টির হার হ্রাস পেয়েছে ।


 বাংলাদেশে ২০১৬ সালে পরিচালিত সর্বশেষ খানা আয় - ব্যয় জরিপ অনুযায়ী ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে আয়ভিত্তিক দারিদ্র্যের হার ৩১,৫ শতাংশ থেকে ২৪.৩ শতাংশে নেমে আসে । অপরদিকে , ২০০৫ সাল থেকে ২০১০ সালের মধ্যে আয়ভিত্তিক দারিদ্র্যের হার ৪০.০ শতাংশ থেকে ৩১.৫ শতাংশে নেমে আসে । ( উৎস । বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা -২০১৯ )


 সরকার গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতি আনয়নের লক্ষ্যে মুক্তিযােদ্ধা এবং হত - দরিদ্র বিশেষ করে বয়স্ক , দুঃস্থ নারী , প্রতিবন্ধী , এতিমসহ আরও অনেককে নগদ ভাতা ও বিনামূল্যে খাদ্য প্রদানের মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করছে । এর পাশাপাশি একটি বাড়ি একটি খামার , আশ্রয়ণ , গৃহায়ণ ইত্যাদি প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে ।


 মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যােগ্য নেতৃত্ব ও দিক নির্দেশনায় উক্ত অর্থনৈতিক কর্মসূচি প্রণয়ন ও সফলভাবে বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশ ইতােমধ্যে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের স্বীকৃতি পেয়েছে । মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে ২০১৫ সালেই বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে । ২০১৮ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করেছে । উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয় , মানবসম্পদ সূচক ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা ও ? উন্নীত বাংলাদেশের অতি হয়েছে । এ কারণে জাতিসংঘ থেকে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে স্বীকৃতি পাবে । উন্নয়নশীল কয়েকটি দেশের সাথে মানব উন্নয়ন সূচকের নিরিখে বাংলাদেশের তুলনা করলেই আমরা এই অঞ্জনের যথার্থতা অনুধাবন করতে পারব ।

তবে যাই বলা হোক না কেন, শেষ বিচারে উন্নয়ন পরিমাপ হলো সংখ্যার ব্যাপার-স্যাপার, অর্থাৎ সংখ্যায় মাপা হয়। যেমন, মোট জাতীয় আয় গাণিতিক সংখ্যায় প্রকাশ করা হয়।কিন্তু উন্নয়নকে যখন সংখ্যা দিয়ে মাপা হয় তখন উন্নয়নের ভাবগত বা গুণগত দিক যেমন, মানুষের অনুভূতি, অভিজ্ঞতা ও অভিমত ইত্যাদি উপেক্ষিত থেকে যায়। এ ধরণের সংখ্যাতাত্ত্বিক পরিমাপ স্থানীয় জনগণের চিন্তা বা মতামতকে টুটি চেপে ধরে বহিরাগত উন্নয়ন ধারণাকে চাপিয়ে দেয়। এ বিতর্কের জ্বলন্ত উদাহরণ হলো, দারিদ্র সংজ্ঞা নিয়ে। যেমন, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহের মূল ধারণাবিন্দুতে হলো দারিদ্র্য বিমোচন। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহের বিপরীতে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়ে হয়েছে, তা একেবারেই অর্থনীতি কেন্দ্রিক।


আর ও পড়ুন...


Comments

Popular posts from this blog

রাষ্ট্র বিজ্ঞান কাকে বলে? || রাষ্ট্র বিজ্ঞান কী? || রাষ্ট্র বিজ্ঞানের বলতে কি বুঝায়? || রাষ্ট্র বিজ্ঞানের সংজ্ঞা দাও? (What is Political Science?)

চাঁদ শব্দের প্রতিশব্দ/ সমার্থক শব্দ কিকি?

GDP ও GNP কাকে বলে? || GDP ও GNP এর মধ্যে পার্থক্য কি?