রচনা :অধ্যবসায় || ছাত্রজীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব || ছাত্রজীবন ও অধ্যবসায়||The importance of perseverance in student life

রচনা :অধ্যবসায় ||ছাত্রজীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব||ছাত্রজীবন ও অধ্যবসায়||The importance of perseverance in student life


  রচনা:অধ্যবসায়(Perseverance)




১।ভূমিকা :

জীবনের প্রতি অধ্যায়
চাই দৃঢ় প্রত্যয়,
চাই ঘাত-প্রতিঘাত
লৌহ কঠিন সত্য হৃদয়।”

উপরের এই কবিতার স্তবকটি পাঠ করলে অধ্যবসায়ের সারাংশ বোঝা যায় খুব সহজে । আমাদের পৃথিবীতে বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস বলেছেন, ‘Our life is full of struggle.’- অর্থাৎ জীবনে সাফল্য লাভের একমাত্র হাতিয়ার হল অধ্যবসায়। এটি মানষের একটি বড় গুণ। এর থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় অধ্যবসায় করলে খুব সহজে অনেক কঠিন জীবন যুদ্ধ জেতা যায়।

২।অধ্যবসায় কি:

মানুষের জীবনে যেকোনাে লক্ষ্য অর্জনের জন্য নিরবচ্ছিন্ন ও একনিষ্ঠ প্রচেষ্টার নাম অধ্যবসায়। যাকে ইংলিশে বলা হয় Perseverance. অবিচল সংকল্প নিয়ে, সকল প্রতিকূলতা অতিক্রম করে, অপরিসীম ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সাফল্য লাভ করা চরিত্রের এই গুণটিই অধ্যবসায়। সেইসঙ্গে উদ্যম , উদ্যোগ , নিরন্তর কর্মপ্রচেষ্টা আর আন্তরিক কঠোর পরিশ্রম অধ্যবসায়কে দেয় পূর্ণতা ।
অক্লান্ত পরিশ্রম, একটানা যত্নশীল উদ্যোগের উপস্থিতি দেখলেই তাকে অধ্যবসায় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

৩।অধ্যবসায়ের বৈশিষ্ট্য :

পারিব না এ কথাটি বলিও না আর

কেন পারিবে না তাহা ভাবো একবার

পাঁচজনে পারে যাহা, তুমিও পারিবে তাহা

পারো কি না পারো করো যতন আবার

একবার না পারিলে দেখ শতবার।’

ক্রমাগত প্রচেষ্টার নাম অধ্যবসায়। উদ্যোগ, পরিশ্রম, আন্তরিকতা প্রভৃতি গুণ একত্র হয়ে অধ্যবসায়ের পরিপূর্ণ রূপ সৃষ্টি করে। সুদৃঢ় সংকল্প সহযোগে কোনো কাজে আত্মনিয়োগ করার সঙ্গে সঙ্গে চরিত্রের অন্য গুণ যখন সক্রিয় থাকে, তখনই অধ্যবসায়ের পরিচয় পরিলক্ষিত হয়। জীবনে সফলতা অর্জনের জন্য অধ্যবসায়ের বৈশিষ্ট্য কর্মপ্রবাহে সঞ্চার করতে হয়। এতে সহজতর হয় জীবনের পরিপূর্ণতা লাভের পথ। হৃদয়ের প্রবল শক্তি ও অপার সাহস দিয়ে জয় করতে হয় জীবন-সংসারের সমগ্র বাধা।


 ৪।অধ্যবসায়ের গুরুত্ব :

 মানবসভ্যতার বিকাশের অন্যতম চালিকাশক্তি অধ্যবসায় । আদিম মানুষ মাটিতে , পানিতে , আকাশে বৈরীশক্তিকে মােকাবেলা করে নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় সফল হয়েছে অধ্যবসায়ের মাধ্যমে । অনাবাদি জমি আবাদ করে ফসল ফলানাে , জলাভূমি ভরাট করে নগর পত্তন , মরুভূমিকে মরূদ্যানে রূপান্তর— সবই অধ্যবসায়ের দান । আদিম গুহাচারী মানুষ আজ মহাশূন্যে পাড়ি জমিয়েছে । জ্ঞান - বিজ্ঞান , সাহিত্য - দর্শন , চিকিৎসা - শিল্পকলা ইত্যাদি প্রতিটি শাখায় মানুষের যে অভাবনীয় অগ্রগতি তার মূলে রয়েছে নিরন্তর সাধনা , উদ্যম , উদ্যোগ আর নিরবচ্ছিন্ন কর্মপ্রচেষ্টা । বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থেও অধ্যবসায়কে একটি চারিত্রিক গুণের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে । 

৫।ব্যক্তিজীবনে অধ্যবসায় :

 জীবনের পথ পরিক্রমায় নানা সমস্যা মােকাবেলার উপায় অধ্যবসায় । অধ্যবসায়ী ব্যক্তির পক্ষেই জীবনসগ্রামে জয়ী হওয়া সম্ভব । যে অধ্যবসায়ী নয় , তার দ্বারা কোনাে মহৎ কাজ সম্ভব নয় । মানবজীবনে অধ্যবসায়ের এ গুণটি চমৎকারভাবে প্রকাশিত হয়েছে 

নিম্নলিখিত কাব্যপক্তিতে : 
‘ কেন পান্থ ক্ষান্ত হও হেরি দীর্ঘ পথ ? উদ্যম বিহনে কার পুরে মনােরথ ? ' 

এ উদ্যম অধ্যবসায়েরই নামান্তর মাত্র ।

 ৬।প্রতিভা ও অধ্যবসায় :

 কেউ কেউ মনে করেন , প্রতিভাই সফলতার মূল নিয়ামক । এ ধারণা পুরােপুরি গ্রহণযােগ্য নয় । অধ্যবসায় ছাড়া সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত হয় না । প্রতিভাবানদের জীবনেও আত্মপ্রতিষ্ঠা আসে অধ্যবসায়ের মাধ্যমে । 

৭।ছাত্রজীবনে অধ্যবসায় :

 ছাত্রজীবন ভবিষ্যৎ জীবন রচনার অনুশীলনক্ষেত্র । তাই অধ্যবসায় ছাত্রজীবনের সবক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে । অধ্যয়ন এবং অধ্যবসায়ের মধ্যে রয়েছে অবিচ্ছেদ্য সংযােগ । বারবার পাঠ অনুশীলনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে জ্ঞান আহরণ করতে হয় । ছাত্রজীবনে অধ্যবসায়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দিলে রচিত হয় জীবনের সাফল্যের বুনিয়াদ । অধ্যবসায় না থাকলে কেবল মেধা কাজে লাগে না । অনেক মেধাবী বিদ্যার্থী যথেষ্ট প্রয়াসের অভাবে জীবনে সফলতা অর্জনে ব্যর্থ হয় । অলস ও শ্রমবিমুখ ছাত্র-ছাত্রী যতই মেধাবী হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত সে বিদ্যার্জনে সফলতা লাভ করতে পারে না। অন্যদিকে একজন অধ্যবসায়ী ছাত্র বা ছাত্রী স্বল্প মেধাসম্পন্ন হলেও ভালো ছাত্র হিসেবে নিজের কৃতিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়। 

ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে-

‘Failure is the pillar of success’

ব্যর্থ না হলে সফলতার মর্ম বোঝা যায় না। তাই একবার অকৃতকার্য হলে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেওয়া বোকামি বরং অধ্যবসায়ের দ্বারা লক্ষ্য অর্জনের দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিত।

৮।মনীষীদের জীবনে অধ্যবসায় :-অধ্যবসায়ের উদাহরণ:

জগতে যত বড় শিল্পী, সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক, সেনানায়ক, ধর্মপ্রবর্তক রয়েছেন, তাঁদের সবাই ছিলেন অধ্যবসায়ী। ইতিহাসের পাতায় পাতায় রয়েছে তার দৃষ্টান্ত। মহাকবি ফেরদৌসি দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে রচনা করেছিলেন অমর মহাকাব্য ‘শাহনামা’। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দশ বিশ বছরের একক প্রচেষ্টায় রচনা করেন পঞ্চাশ হাজারের বেশি শব্দ সংবলিত বাঙলা ভাষার অভিধান। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই নিজের চেষ্টা ও সাধনায় দরিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করে সংগ্রহ করেছিলেন দু’হাজার প্রাচীন পুঁথি, যার ফলে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রায় চার’শ বছরের ইতিহাসের অজানা অধ্যায় উদ্ঘাটিত হয়। ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে বেরোয় জনসনের বিখ্যাত অভিধান ‘এ ডিকশনারি অফ দি ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ’ যাকে ইংরেজ জাতি গ্রহণ করে এক মহৎ কীর্তিরূপে : ফরাসিরা যা সম্পন্ন করেছে একাডেমির সাহায্যে ইংরেজ তা করেছে এক ব্যক্তির শ্রমে-মেধায়, এ-তৃপ্তি পাওয়ার সাথে সাথে ভাষার মানরূপ শনাক্তির জন্যে একাডেমি প্রতিষ্ঠার সমস্ত স্বপ্ন ত্যাগ করে ইংরেজ। মনীষী কার্লাইল অনেক বছরের শ্রমে ফরাসি বিপ্লবের এক অসামান্য ইতিহাস লিখেছিলেন। এ-সবই অধ্যবসায়ের ফসল। স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রুস অধ্যবসায়ের আর এক জীবন্ত উদাহরণ। অগণিত ইংরেজ সৈন্যের সাথে পুনঃপুন যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পলায়ন করতে বাধ্য হয়েও রবার্ট ব্রুস ইংরেজ বাহিনীকে পরাজিত করার বাসনা ও চেষ্টা পরিত্যাগ করেন নি। বরং একনিষ্ঠ অধ্যবসায়ের ফলে তিনি যুদ্ধে জয়ী হন। এমনিভাবে স্যার ওয়াল্টর স্কট প্রমুখ ব্যক্তিগণও বার বার ব্যর্থ হয়েও অধ্যবসায়ের দ্বারা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। মহাবিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন নিজেই স্বীকার করেছেন বিজ্ঞানে তাঁর অবদানের মূলে আছে বহু বছরের একনিষ্ঠ ও নিরবচ্ছিন্ন শ্রম।
 নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছেন,

“Impossible is a word, which is only found in the dictionary of fools.”

 ৯।জাতীয় জীবনে অধ্যবসায় : 

সামগ্রিকভাবে জাতির সগৌরব প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রত্যেক নাগরিকেরই অধ্যবসায়ী হওয়া প্রয়ােজন । জাতীয় জীবনে অধ্যায়ের প্রতিষ্ঠা করতে হলে ব্যক্তিজীবনে তার অনুশীলন প্রয়ােজন । এদিক থেকে জাতির বৃহত্তর কল্যাণে অধ্যবসায়ী ব্যক্তির গুরুত্ব অনেকখানি ।

১০।অর্থনীতি ও অধ্যবসায় :

একটি দেশের অর্থনীতি নির্ভির করে সে দেশের মানুষ কতটা পরিশ্রমী। একটি দেশের অর্থনীতির কাঠামো নির্মাণ হয় ওই দেশের মানুষ দ্বারা। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে অনুন্নত দেশের মানুষ  উন্নত দেশের মানুষের  চেয়ে কম পরিশ্রমী। উন্নত বিশ্বে যা কিছু অর্জিত হয়েছে তার পিছনে অধ্যবসায় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। দেশের অর্থনীতি যদি শক্তিশালী না হয় তবে সে দেশে দেখা দেয় নানা সমস্যা। অর্থের অভাবে সে দেশে উন্নয়ন হয় মন্থর। কাজেই অধ্যবসায় একটি দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্ত করতে।

১১।অধ্যবসায়হীনের অবস্থা: 

প্রবাদ আছে-
‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা’।

অধ্যবসায়হীন, শ্রমবিমুখ ব্যক্তিরা কেবলমাত্র দেশ ও জাতির অন্ন ধ্বংস করতে পারে। অধ্যবসায়হীন ব্যক্তি কেবল নিজের জন্যই নয়, সমগ্র জাতির জন্য ক্ষতির কারণ। অধ্যবসায় না থাকলে ছাত্রজীবন, ব্যক্তিজীবন, জাতীয় জীবন, কোনো ক্ষেত্রেই সাফল্য লাভ করা যায় না। ফলে কোনো কাজেই সফলতা অর্জন করতে না পেরে অধ্যবসায়হীন ব্যক্তির জীবন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং সর্বোপরি সে সমাজের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়।

 ১২।উপসংহার : 

জীবনে সাফল্য লাভ করে জাতিকে গৌরবান্বিত করার ক্ষেত্রে অধ্যবসায়ের বিকল্প নেই । লক্ষ্যে পৌছানাের উদ্যমী নিরন্তর প্রচেষ্টা থাকলে কোনাে প্রতিকূলতাই জাতিকে নিরস্ত করতে পারে না । অধ্যবসায়ী মানুষ ধৈর্য ও অবিচলতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে একসময় - না - একসময় সাফল্য ছিনিয়ে আনে । প্রতিটি সফল জীবন এক অর্থে অধ্যবসায়েরই চালচিত্র । তাই ছােটবেলা থেকে প্রত্যেকের উচিত এই বিশেষ গুণের অধিকারী হওয়া ।


আর ও পড়ুন...

Comments

Popular posts from this blog

রাষ্ট্র বিজ্ঞান কাকে বলে? || রাষ্ট্র বিজ্ঞান কী? || রাষ্ট্র বিজ্ঞানের বলতে কি বুঝায়? || রাষ্ট্র বিজ্ঞানের সংজ্ঞা দাও? (What is Political Science?)

চাঁদ শব্দের প্রতিশব্দ/ সমার্থক শব্দ কিকি?

GDP ও GNP কাকে বলে? || GDP ও GNP এর মধ্যে পার্থক্য কি?