চন্দ্র বিন্দু কি? || চন্দ্র বিন্দুর অর্থ কি? || চন্দ্রবিন্দুর ব্যবহারের নিয়ম?
চন্দ্র বিন্দু কি? || চন্দ্র বিন্দু ব্যবহারের নিয়ম:
চন্দ্রবিন্দু :
চন্দ্রবিন্দু একটি বৈশিষ্ট্যসূচক বা ধ্বনিনির্দেশক চিহ্ন যা দেখতে একটি অর্ধচন্দ্র (অর্ধেক চাঁদ) আকারের উপর বিন্দুর ন্যায়। এর উৎস সংস্কৃত ভাষা ও ব্রাহ্মী লিপি থেকে এবং এর ব্যবহার দেবনাগরী, বাংলা, গুজরাটি, ওড়িয়া, তেলুগু ও জাভানীয় লিপিতে। এই চিহ্নের অর্থ পূর্বের স্বরধ্বনিটি আনুনাসিক ("নাকা") হবে।বাংলা বর্ণমালায় একটি ছোট পরাশ্রয়ী বর্ণ বা ছোট চিহ্ন হলো চন্দ্রবিন্দু(৺)। এই বর্ণটি স্বাধীনভাবে কোনো বাংলা শব্দে ব্যবহৃত হয় না। অন্য বর্ণের আশ্রয়ে এই বর্ণটি উপস্থাপিত হয়, তাই একে পরাশ্রয়ী বর্ণ বলা হয়।
#এ - ধ্বনির ভূমিকা প্রসঙ্গে মুহম্মদ আবদুল হাই - এর মন্তব্য :
“ বাঙলায় স্বরধ্বনিকে সানুনাসিক করার চিহ্ন ( '৺ ) চন্দ্রবিন্দু ; ইংরেজি নাম moon - dot । ” এ - সব অনুনাসিক স্বরধ্বনি উচ্চারিত হয় নাক ও মুখের মিলিত দ্যোতনায় ( " Combined resonance of nose and mouth " ) । একে অনেকে ‘ নাকিসুরে উচ্চারণ বলে থাকেন । বাঙলাদেশের সর্বত্র এ - উচ্চারণ নিখুত হয় না ( এমনকি বহু শিক্ষিত লােকেরও ) । কিন্তু এর উচ্চারণ বিকৃতি বা বিলুপ্তির জন্যে শব্দের অর্থগত বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে ওঠে ।
যথা : কাদা ( কর্দম ) , কাঁদা ( ক্রন্দন ) ; শাখা ( ডাল ) , শাঁখা ( শখ ) ; রাধা ( রাধিকা ) , রাঁধ ( রন্ধন ) ; পাক ( পবিত্র / রান্না ) , পাক ( পুকুরতলের কাদা ) ইত্যাদি
এক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষণীয় । যেসব মূল শব্দ বর্গের পঞম বর্ণ - সহযােগে ( ঙ , ঞ , ণ , ম ) গঠিত , সে সব শব্দের পরিবর্তিত ( তদ্ভব ) রূপেই সাধারণত নাসিক্য (৺)প্রতীক ব্যবহূত হয় ।
যথা : চাঁদ ( ( চ ) , ছাঁদ ( ছন্দ ) , দাঁত ( দন্ত ) , কাঁটা ( কণ্টক ) , যাঁড় ( ষণ্ড ) , ভাঁড় ( ভাণ্ড ) , দাঁড় ( দণ্ড ) , পাঁচ ( পঞ ) , আঁচল ( অল ) , আঁধার ( অন্ধকার ) ইত্যাদি ।
আবার বাংলা ভাষায় বেশ কিছু জোড়শব্দ রয়েছে যেগুলোতে চন্দ্রবিন্দু থাকা, না-থাকার কারণেই অর্থের পার্থক্য ঘটে।
যেমন, রাঁধা-রাধা, বাধা-বাঁধা, গাদা-গাঁদা, কাদা-কাঁদা, কাচা-কাঁচা, ভাজা-ভাঁজা, গা-গাঁ, বা-বাঁ, কাটা-কাঁটা, বাটা-বাঁটা, গোড়া-গোঁড়া, ধোয়া-ধোঁয়া, পাক-পাঁক ফোটা-ফোঁটা, আধার-আঁধার, কুড়ি-কুঁড়ি, দাড়ি-দাঁড়ি, শাখা-শাঁখা ইত্যাদি।
# হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ
চন্দ্রবিন্দু-কে অনুনাসিক বর্ণ বলা হয়েছে। চন্দ্রবিন্দুর নিজস্ব কোনো ক্ষমতা বা শক্তি নেই- এই বর্ণটি পরাশ্রয়ী ও অবহেলিত মনে হলেও বাংলাভাষায় এর অনেক প্রভাব ও সম্মান- এতো যে অন্য বর্ণমালাগুলো এর ধারে কাছেও আসতে পারে না। বাংলাভাষায় সম্মানসূচক সর্বনাম পদে চন্দ্রবিন্দুর ব্যবহার হয়ে আসছে সেই আবহমান কাল থেকে।
যেমন- তাঁরা, যাঁরা, তাঁদের, যাঁদের, তাঁকে, যাঁকে- অর্থাৎ বাংলাভাষায় খুব সম্মানিত কারো ক্ষেত্রেই চন্দ্রবিন্দুর ব্যবহার করা হয়।
এছাড়াও স্বর্গীয় অথবা মৃত হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্যক্তির নামের আগে এই চন্দ্রবিন্দু চিহ্ন বসে । যেমন- ৺রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অর্থাৎ স্বর্গীয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। চন্দ্রবিন্দু যে বর্ণের উপর বসে, সেই বর্ণের উচ্চারণ আনুনাসিক হয়। কেবল স্বরবর্ণ ও স্বরান্ত ব্যঞ্জনের সঙ্গে এটি যুক্ত হতে পারে।
#পাণিনি তাঁর অষ্ট্যাধ্যায়ী ব্যাকরণের অষ্টধ্যায়ের চতুর্থ পাদের ৫৮-৫৯ সূক্তে চন্দ্রবিন্দুকে সানুনাসিক হিসাবে উল্লেখ করেছেন। এই সূক্তদ্বয়ে দেখানো হয়েছে কি প্রক্রিয়া 'ং' চন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, সংস্কৃত মতে অনুস্বার (ং) একমাত্রা বিশিষ্ট। এই ধ্বনি অর্ধ-মাত্রায় রূপ নিলে তা চন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। পাণিনি উদাহরণ হিসাবে দেখিয়েছেন কিংযুক্তম্>কিঁয্যুক্তম্, সংযন্তা>সঁয্যন্তা, সংবৎসরঃ>সঁব্বৎসরঃ ইত্যাদি।
#বশীর আল হেলাল তাঁর
‘বাংলাভাষার নানান বিবেচনা’ বইটিতে চন্দ্রবিন্দু সম্পর্কে একটি স্বতন্ত্র নিবন্ধে লিখেছেন, ‘যথাযথ অর্থনিষ্পত্তির প্রয়োজনে চন্দ্রবিন্দুর যথাযথ ব্যবহার আবশ্যক।
চন্দ্রবিন্দু নিয়ম:
●মূল শব্দের নাসিক্য ধ্বনি ঙ, ঞ, ণ, ন লুপ্ত হলে বাংলা শব্দে চন্দ্রবিন্দু ব্যবহৃত হয়- অঞ্চল > আঁচল, পঙ্ক > পাঁক, বৃন্ত > বোঁটা, ক্রন্দন > কাঁদান।●সম্মানসূচক সর্বনাম পদে চন্দ্রবিন্দুর ব্যবহার হয়- তাঁরা, যাঁরা, তাঁদের, যাঁদের, তাঁকে, যাঁকে।
●সংখ্যাবাচক শব্দে চন্দ্রবিন্দুর ব্যবহার হয়- পাঁচ, পঁচিশ, পঁচাশি।
●দ্বিরাবৃত্ত শব্দে চন্দ্রবিন্দু ব্যবহৃত হয়- আঁকাআঁকি, খোঁচাখুঁচি।
●ক্রিয়াবাচক শব্দে চন্দ্রবিন্দু ব্যবহৃত - কাঁদা, রাঁধা।
●তদ্ভব শব্দে চন্দ্রবিন্দুর ব্যবহৃত হয়- গাঁ > গ্রাম, চাঁদ> চন্দ্র।
ব্যতিক্রম:
কখনও দেখা যায় নাসিক্যধ্বনি বিলুপ্ত হলেও চন্দ্রবিন্দু হয় না। যেমন- কঙ্ক > কাক, কর্দম > কাদা, কৃপণ > কিপটে, কৃষ্ণ > কালো, ঝঞ্ঝা > ঝড়, টঙ্কা > টাকা, লম্ফ > লাফ, শৃঙ্খল > শিকল।
চন্দ্রবিন্দু যতটা অন্য বর্ণের সহযোগী, তার চেয়ে বেশি বোঝা। কিন্তু এ বোঝা অত্যন্ত মধুর। কারণ, সানুনাসিক ধ্বনি কোনো ভাষার সমগ্র ধ্বনিরূপকে স্নিগ্ধ করে দেয়। বাংলা ও ফরাসি ভাষা শ্রবণে মধুর, তার অন্যতম কারণ হলো, উভয় ভাষাতেই সানুনাসিক ধ্বনি প্রচুর ব্যবহৃত হয়।
চন্দ্রবিন্দু ঠিক বর্ণ নয়, একে বরং বলা চলে চিহ্ন। এই চিহ্নটি বর্ণেও ঠিক কোথায় বসবে, তা নিয়েও মতবিরোধ রয়েছে। কারো মতে, চন্দ্রবিন্দু বসা উচিত বর্ণের ঠিক মাথার উপর। বাকিদের মত হচ্ছে, ওটাকে পুরোপুরি মাথায় তুলে লাভ নেই। বর্ণের ডানপাশে বসিয়ে দিলেই বেঁচে-বর্তে যাবে।চন্দ্রবিন্দু ব্যঞ্জনধ্বনি। কারণ এই ধ্বনি অপর কোনো স্বরধ্বনি ছাড়া উচ্চারিত হয় না।
আর ও পড়ুন...
Comments
Post a Comment